বিদ্যাপতি

একছত্রও বাংলা পংক্তি রচনা করেননি, তবুও তাঁকে বাংলা বৈষ্ণব পদসাহিত্য থেকে বাদ দেবার উপায় নেই। তিনি হলেন 'বিদ্যাপতি'। তিনি বাঙালী নন, বাংলা ভাষাতেও তাঁর কোন রচনা নেই, লিখেছেন মাতৃভাষা মৈথিলিতেই। কিন্তু মধ্যযুগে তিনি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় কবি ছিলেন। তাকে মধ্যযুগের 'কবি সার্বভৌম' বলা হয়। কেউ কেই তাঁকে বলেন 'Cosmic Imagination' । বস্তুত তার মতো উচ্চমার্গীয় গীতিকবিতা মধ্যযুগের পূর্বে আর কেউ রচনা করতে পারেন নি।
মিথিলার একাধিক রাজার সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা মিথিলার রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। কেউ ছিলেন রাজসভাপণ্ডিত, কেউ ছিলেন সেনাপতি। কিন্তু বিদ্যাপতি মৈথিলি রাজসভার কোন পদাধিকারী ছিলেন না। ধারণা করা হয় 'বিদ্যাপতি' কোন ব্যক্তিবিশেষের নামও নয়। এই শব্দটি এক বিশেষ ধরণের গীতি রচয়িতা কবিদের সাধারণ নাম। এদের মধ্যে মৈথিল ছিল, বাঙালি ছিল, আবার নেপালীও ছিল। এঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনিই আমাদের আলোচ্য কবি। ইনি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়ে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁর পাণ্ডিত্য তাঁকে রাজাদের সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। তার কয়েকটি বিখ্রাত গ্রন্থ হল ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রচিত 'ভুপরিক্রমা', ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে রচিত 'পুরুষ পরীক্ষা' ও 'কীর্তিপতাকা', ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত 'লিখনাবলী', ১৪৩০-৪০ খ্রিস্টাব্দে রচিত 'শৈবসর্বস্বহার' ও 'গঙ্গাবাক্যাবলী', ১৪৪০-৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত 'বিভাগসাগর', 'দানবাক্যাবলী' ও 'দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী'। ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন -
"পান্ডিত্যে তিনি সারা মিথিলায় শ্রদ্ধান্বিত স্থান লাভ করেছিলেন, তাঁর কোন কোন সংস্কৃত গ্রন্থ একদা বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়েছিল। স্মৃতি-সংহিতা ও নানাশাস্ত্রে সুপন্ডিত বিখ্যাত ব্রাহ্মণ-কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর মিথিলার সংস্কৃতিতে চরম শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত আছেন। মিথিলায় বার বার মুসলমান আক্রমণ ও অধিকারের ফলে এ অঞ্চলের হিন্দু সংস্কৃতি বিশেষভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল। দেশ আবার মিথিলা রাজাদের অধিকারে এলে মিথিলার বিপর্যস্ত হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির পুনর্গঠনের ভার তাঁরা বিদ্যাপতির ওপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। বিদ্যাপতিও সংস্কৃতে পৌরাণিক ও স্মৃতি গ্রন্থাদি রচনা ও প্রচার করে মিথিলার শিথির হিন্দু সমাজকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। এই জন্য মিথিলার সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে তাঁর দান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত হয়।"
বিদ্যাপতির প্রধান কৃতিত্ব তাঁর রাধাকৃষ্ণ পদাবলীগুলিতে। এই বিষয়ক তাঁর রচিত পদসংখ্যা পাঁচশ'র ও বেশি। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি তাঁর রচনায় নায়ক নায়িকার পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, অভিসার, কলহ, মান, অভিমান, বিরহ, পুনর্মিলন প্রভৃতি বর্ণনা করেছেন।
তাঁর একটি বিখ্যাত পদ হল:-
সখি, হমরি দুখক নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।
ঝম্পি ঘন গর- জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খরশর হন্তিয়া।।
কুলিশ কত শত পাত মোদিত
মৌর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছতিয়া।।

কোন মন্তব্য নেই:

বই আলোচনা সমালোচনা

সাহিত্যের Webzine