বাংলার সীমানা

নীহারঞ্জন রায় এর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে বঙ্গভূমির সীমানার একটি সুন্দর বর্ণনা আছে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩ ৫৬ সালে।
উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ধৃত নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য; উত্তর-পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল-সাঁওতাল পরগনা-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম-কেওঞ্জর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রাকৃতিক সীমাবিধৃত ভূমিখণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাঙলার গৌড়-পুন্ড্র-বরেন্দ্রী-রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ; ভাগীরথী-করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদনদীবিধৌত বাঙলার গ্রাম, প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূখণ্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি। একদিকে সু-উচ্চ পর্বত, দুইদিকে কঠিন শৈলভূমি, আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য- ইহাই বাঙালীর ভৌগলিক ভাগ্য। আজ হিমালয় আমাদের নামমাত্রই; সমুদ্রও বুঝি নামমাত্র; তাম্রলিপ্তি সত্যই সকরুণ স্মৃতি। সাম্প্রতিক বাঙলার উত্তরে তরাই বনভূমি, দক্ষিণে সুন্দরবন ও তৃণাস্তীর্ণ জলাভূমি। এই দুইয়ে মিলিয়া যেন বাঙলাদেশকে উষ্ণ জলীয়তার ক্লান্ত অবসাদে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। বিংশ শতাব্দীর এক বাঙালী কবির লেখনীতে এই ভৌগলিক ভাগ্য সুন্দর কাব্যময় রূপ গ্রহণ করিয়াছে। কবিতাটি সমগ্র উদ্ধৃতির দাবি রাখে:

হিমালয় নাম মাত্র,
আমাদের সমুদ্র কোথায়?
টিমটিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি।
সমুদ্রের দু:সাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;
-তাম্রলিপ্তি সকরুণ স্মৃতি।

দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন আছে বটে সমতল সবুজ খেতের,
কত উগ্র নদী সেই স্বনেতে গেল মজে হেজে;
একা পদ্মা মরে মাথা কুটে।

উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি
দক্ষিণেতে দুরন্ত সাগর
যে দারুণ দেবতার বর,
মাঠভরা ধান দিয়ে শুধু
গান দিয়ে নিরাপদ খেয়া-তরণীর
পরিতৃপ্ত জীবনের ধন্যবাদ দিয়ে
তারে কভু তুষ্ট করা যায়!
ছবির মতন গ্রাম
স্বপনের মতন শহর
যতো পারো গড়ো,
অর্চনার চূড়া তুলে ধরো
তারাদের পানে;
তবু জেনো আরো এক মৃত্যুদীপ্ত মানে
ছিলো এই ভূখণ্ডের,
-ছিলো সেই সাগরের পাহাড়ের দেবতার মনে।
সেই অর্থে লাঞ্ছিত যে, তাই,
আমাদের সীমা হল
দক্ষিণে সুন্দরবন
উত্তরে টেরাই!
['ভৌগলিক']- প্রেমেন্দ্র মিত্র

কোন মন্তব্য নেই:

বই আলোচনা সমালোচনা

সাহিত্যের Webzine