ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এর মৃত্যুর (১৭৬০) পর বাংলা সাহিত্যে শতাব্দীকালব্যাপী কোন নতুন কাব্যপ্রকরণের উদ্ভব হয়নি। ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় এর মতে "কবিওয়ালাদের উচ্চকিত উল্লাস বাংলা সাহিত্যের হাঁটুজলে ঘোলাটে বুদবুদ সৃষ্টি করেছিল।" এই হাঁটুজলের ডোবাতে ঈশ্বর গুপ্ত যে ক্ষীণ স্রোতধারার সঞ্চার করেছিলেন তা জলোচ্ছাসে পরিণত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্পর্শ ঈশ্বর গুপ্ত তেমন পাননি। ফলে তাঁর স্বভাবপ্রকৃতি আধুনিক শিক্ষার দ্বারা মার্জিত হননি। তিনি প্রধানত 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকা প্রকাশ করতেন। নিজেই ছিলেন সম্পাদক। এই পত্রিকার কারণে তিনি যে যুগের সংস্কৃতিমান বাঙালির মনে এক বিশেষ স্থান লাভ করেছিলেন। শুধু অভিজাত ব্যক্তিবর্গ নয়, ইংরেজ শাসকরাও তার পত্রিকার নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন। বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর পুঁথিগত বিদ্যার দুর্বলতাকে অনেকাংশেই ঢেকে দিয়েছে। নিয়মিত প্রকাশনার প্রয়োজনে তাকে নিয়মিত তাৎক্ষণিকভাবে লিখতে হত। যথাযথ শিক্ষার অভাব ও কালিক প্রয়োজন তার সৃষ্টিসম্ভারের শিল্পসৌকর্য অনেক সময় হালকা করে দিয়েছে। স্বভাবসুলভ পরিহাসপ্রিয়তাকে তাই তিনি ক্ষেত্র বিশেষে পরিমিত রাখতে পারেননি। তাই তাঁর অধিকাংশ রচনা, হাস্যকৌতুক, ভাঁড়ামোর বাহন হয়ে পরেছে।
তাঁর সৃষ্টিভাণ্ডারে ঈশ্বরপ্রেম, নীতিবাচক, প্রকৃতিলগ্নতা, নারীপ্রেম, দেশপ্রেম, সমকালীন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বিভিন্ন বিচিত্র প্রকৃতির রচনা রয়েছে। অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় এর মতে- "বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর ভিত্তি করে কলকাতার জীবনে বসে তিনি প্রকৃতির যে মূর্তি উপলব্ধি করেছেন, তার রঙ্গপরিহাস অতিশয় উপভোগ্য হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রেম-প্রণয় ঘটিত যে কবিতাগুলি লিখেছেন, সেগুলি গতানুগতিক, কৃত্রিম এবং স্থানে স্থানে হাস্যকর হয়ে পড়েছে।" কলকাতার কাছাকাছি 'কাঁচড়[পাড়া' নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়। শৈশবে মাতৃহীন হন। যৌবনে স্ত্রীর সাহচর্য তেমন পাননি। ফলে সংহত আবেগ তার জীবনে কোন সুক্ষ্ম সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেনি। বাস্তব জীবনের জটিলতা তাকে আবেগচর্চার কোন সুযোগ দেয়নি। তাই প্রেম তাঁর কাছে হাস্যকার যন্ত্রণার চাইতে বেশি কিছু ছিল না।
তবে তাঁর স্বদেশপ্রেম বিষয়ক কবিতাগুলো নিজগুণেই বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে। সেযুগে পাশ্চাত্য আদর্শের বলে বলীয়ান হয়ে স্বদেশী 'ইয়ং বেঙ্গল'রা তাদের বিভিন্ন আলোচনা ও রচনায় দেশপ্রেমর প্রচারকার্য চালাতেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের মর্মে প্রবেশ করত না। ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম দেশপ্রেমের উজ্জীবনী মন্ত্র বাংলাভাষায় প্রচার শুরু করেন। জন্মভূমির মমতায় আবেগে আকুল হয়ে তার মতো করে এর আগে আর কেউ কাব্য রচনা করেনি।
জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি
ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে।
তোমার কুমার যত সকলেই জ্ঞানহত
মিছে কেন মর ভার বয়ে?
তার আরেকটি কবিতায় তার দেশপ্রেমিক মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যা। জন্মভূমিকে বাংলা কবিতায় এভাবে বন্দনা করার উদাহরন বিরল।
মিছা মণি মুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।
সুধাকরে কত সুধা দূর করে তৃষ্ণাক্ষুধা
স্বদেশের শুভ সমাচার।
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে দেখ দেশবাসিগণে
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।
সমাজজীবনকে ব্যঙ্গ করে রচিত কৌতুককর কবিতাগুলি ঈশ্বর গুপ্তকে বাংলা সাহিত্যে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল। বিভিন্ন অসঙ্গতিকে বিদ্রপের হুল ফোটাতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলো হল -'ধন্য রে বোতলবাসী ধন্য লাল জল,' 'আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল ব্রতকর্ম কর্তো সবে,' 'সোনার বাঙাল করে কাঙাল ইয়ং বাঙাল যত জনা,' 'এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা,' 'কসাই অনেক ভালো গোসাইয়ের চেয়ে,' এমন পাঠার নাম যে রেখে বোকা, নিজে সেই বোকা নয় ঝাড়ে বংশে বোজা,' 'এই কালোর ভিতর আলো আছে, ভালো করে দেখ জ্বেলে,' ইত্যাদি।
তিনি সমসাময়ি বিভিন্ন ঘটনাকে আম্রয় করে যে ধরণের ব্যঙ্গ কবিতা লিখেচেন তাকে ফরাসি ভাষায় বলে 'vers de societe' অর্থাৎ 'সমাজকে নিয়ে লেখা হালকা চালের কবিতা'।
অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় এর মতে -"ভাবাবেগে আর্দ্র বাংলা সাহিত্যে তিনি বুদ্ধির চমক একেছেন এর জন্য তিনি বাংলা কাব্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ড্রাইডেন সম্বন্ধে বলা হয়, "Libritium invenity, marmoream peliquit' অর্থাৎ 'ইটের টুকরোকে তিনি মার্বেল পাথরে পরিণত করেছিলেন'। কোন কোন দিক থেকে ঈশ্বরগুপ্তের প্রসঙ্গে উক্ত লাতিন প্রবচনটি প্রযুক্তহতে পারে।"
ঈশ্বরগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁকে অনেকে ভুলে যাচ্ছিল। বিপরীত মনোভঙ্গির কবি হয়েও মাইকেল মধুসূদন দত্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন-
"আছিলে রাখালরাজ কাব্য-ব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলে হরষে;
যমুনা হয়েছে পার, তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা?"
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে তাঁর শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছেন তার চাইতে বেশি কিছু বলার আর অবকাশ নেই।
তিনি বলেছেন-"মনুষ্যহৃদয়ের কোমল, গম্ভীর, উন্নত, অস্ফুট ভাবগুলি ধরিয়া তাহাকে গঠন দিয়া, অব্যক্তকে তিনি ব্যক্ত করিতে জানিতেন না; সৌন্দর্যসৃষ্টিতে তিনি তাদৃশ পটু ছিলেন না।... যাহা আছে ঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি। তিনি এই বাঙ্গালা সমাজের কবি। তিনি বাঙ্গালার গ্রাম্যদেশের কবি।...ঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং ঈশ্বর গুপ্ত Satirist।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন